২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ মিছিলে নারীরা

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ মিছিলে নারীরা

 

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর শহীদ স্মরণে নারীদের প্রভাতফেরি, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩

১৯৫২ মিছিলে নারীরা একুশের গল্প। তবে গল্প নয়, সত্যি, একদম সত্যি ঘটনা এবং তা ঘটেছিল সেই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। অনেক দিন আগের কথা, কিন্তু তা হলে কী হবে, একুশে এখনো অত্যুজ্জ্বল। মহান একুশের কথা আমরা এখনো ভুলতে পারি না। প্রশ্ন হতে পারে, আমি ঘটনাটা কেমন করে জানলাম। তার জবাবে বলছি, আমি সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে, আমতলায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি বিভাগে ঢোকার পথে বড় একটা ফটকের ওপর পুরোনো একটা ফলকে লেখা আছে সেদিনের পরিচয়। আমি সেই তীর্থক্ষেত্রে ছিলাম। আমি একা নই, হাজার হাজার শিক্ষার্থী সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। কেন?

এই ‘কেন’র জবাব অনেক দীর্ঘ। একুশের কথা বলতে হলে তার আগের কথা বলতে হয়—৪ ফেব্রুয়ারি, ১১ ফেব্রুয়ারি এবং তার আগের দিন ও বছরগুলোর কথা। শুধু তা-ই নয়। আরও পিছিয়ে আমার জন্ম, আমার শৈশব, আমার বর্ণমালা শেখা, পড়তে শেখা, বাংলা ভাষার সুধাময় ছন্দে, গানে, কবিতায়, গল্পে, কথায়, সারা মনকে সিক্ত করা—এ সবকিছু বলতে হয়। এবং আরও কিছু।

জন্মেই পেয়েছি মাকে। মায়ের ভাষা বাংলা। মায়ের পেট থেকেই তো আমার ভাষা বাংলা। সে ভাষার ওপর আঘাত আমি কি সইব? না! না! না! পেয়েছি বাবাকে। পেয়েছি ভাই-বোন, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, খালা ও ফুফু—তাঁদের সবার ভাষা বাংলা। জন্ম-জন্মান্তরের এই ভাষা সাধনায় পাওয়া, ঈশ্বরের দান, পৃথিবীর দান, আমার অস্তিত্বের অস্তিত্ব। বিনা যুদ্ধে সে ভাষার দাবি আমরা কেউ কোনো দিনও ছাড়ব? ছাড়ব না।

আগে যে লেখাপড়ার কথা বলছিলাম, সেই লেখাপড়ার কথায় ফিরে যাই। পড়া শিখেই রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি, পেয়েছি অতুল প্রসাদকে, নজরুলকে, শরৎচন্দ্রকে আর পেয়েছি বাংলাদেশকে। সারা উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশের করালগ্রাসে, ইংরেজদের অধিকারে, তাদের চরম নিষ্ঠুরতার শৃঙ্খলে বাঁধা। আমরা পরাধীন। তাই সেই শৈশবেই মনের মধ্যে ইংরেজ তাড়ানোর জন্য কারখানা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। দেশের মাটি ও মানুষকে বেদনামুক্ত করার জন্য ফাইভ-সিক্সে পড়ার সময় থেকেই ইংরেজবিরোধী শোভাযাত্রা, সভা ও সমাবেশে যাওয়া শুরু করি। আরও কিছু পরে নেতাজি সুভাষ বসুর প্রেরণা মনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করল। তখন যেন মনে মনে তাঁর সেনাদলের সঙ্গে কদম কদম এগিয়ে যেতে লাগলাম দূর দুর্গম বিপ্লবী পথের দিকে। অনেক যন্ত্রণার সাগর পার হয়ে উদয়ের পথে হারিয়ে যাওয়া অনেক স্বাধীনতাসংগ্রামীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ স্বাধীন হলো। ইংরেজ ভারত ছাড়তে বাধ্য হলো। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো সে স্বাধীনতা যেন শূন্যে মিলিয়ে যেতে বসল। দুই পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলল সেই প্রথম থেকেই। পশ্চিম পাকিস্তানের ওপরওয়ালারা আমাদের পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের উপনিবেশ বানিয়ে শাসন ও শোষণ করতে লাগল।

তারপর তারা আমাদের ভাষার ওপর মোক্ষম আঘাত হানল। বোকামি করে পশ্চিমা ওপরওয়ালারা প্রচার করতে লাগল, বাংলা ভাষার উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে, তাই এটা অপবিত্র, এ ভাষার মানুষ সব ছোট জাত। এ ভাষা রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

এরই মধ্যে কলেজে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে সাম্যবাদের শিক্ষা লাভ করেছি। চোখের ওপর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পাকিস্তান হয়েছে, কিন্তু স্বাধিকার পাইনি। শান্তির বদলে এসেছে অত্যাচার, কারাগার। ভাতের বদলে বুলেট? তাই গণনাট্য সংঘের উচ্চারণে বলেছি, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়।’ মনের মাটি এভাবেই শক্ত হয়েছিল, তাই ১৯৫২ সালে যখন প্রিয় মাতৃভাষার ওপর অন্ধকার নেমে এল, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা তাকে দেওয়া হবে না। চক্রান্ত হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাদের জীবন ও জীবিকার ওপর ভিক্ষার ঝুলি চাপিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অত সহজে এই ষড়যন্ত্র মেনে নিল না। শুরু হলো আলোচনা, সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল।

 

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই—এই হলো সবার মূলমন্ত্র। আমিও তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে সব ছাত্রের সঙ্গে গর্জে উঠলাম এবং আমাদের অস্তিত্ববিরোধী সরকারের আরোপিত ১৪৪ ধারা ভাঙতে সবার আগে বের হয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা চারজন চারজন করে দল বেঁধেছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল স্কুল থেকে আইন অমান্য করে বের হয়ে আসা ছোট কয়েকটি মেয়ে। তারা হলো সেতারা, জুলেখা, আখতারী, নূরি প্রমুখ। তারা মিছিলে এসেছিল দেশকে ভালোবেসে, মাতৃভাষাকে ভালোবেসে। পুলিশের বন্দুক নরম পায়ে ঠেলে এসেছিল তারা। আইন অমান্য করার, ভাষা বাঁচানোর, পুলিশের বাধা ভাঙার মন্ত্র আমরা তাদের শিখিয়েছিলাম। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্রী। বাড়ি আমার অনেক দূর, প্রায় সুন্দরবনের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য তাই হোস্টেলে ছিলাম। কমিউনিস্ট পার্টির এক আপা হোস্টেলে এসে আমাদের উৎসাহ দিতেন, ভাষা বাঁচানোর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্র শোনাতেন এবং আন্দোলনের কর্মপন্থা বলে দিতেন। নাম তার যুঁইফুল রায়।

সাধারণ ছাত্রদের চাপে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্তের পর স্লোগান উঠল—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ‘চল, চল, অ্যাসেম্বলি চল।’ ঠিক হলো ছাত্ররা ১০ জন করে দল বেঁধে পুলিশের বাধা পার হয়ে বের হবে। মেয়েরা চারজন। সবার প্রথমে আমি তিনজন মেয়েকে নিয়ে এবং আরেকজন তিনজন মেয়েকে নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে পুলিশের বন্দুকের নল ঠেলে বের হলাম। রাস্তায় বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে লাগল। আমাদের পরে সাফিয়া খাতুনের নেতৃত্বে আরও আটজন বের হলে পুলিশ তাদের অ্যারেস্ট করে ভ্যানে তুলে নেয়। ছাত্ররা তখন বন্যার জলের মতো স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে আসে। তখন প্রচণ্ড লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস চলতে থাকে। আমরা সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভলান্টিয়াররা তখন বালতি ভরে পানি এনে আমাদের কাছে ধরল। বালতির পানিতে রুমাল ভিজিয়ে, আঁচল ভিজিয়ে চোখে পানি দিয়ে স্লোগান দিতে দিতে আমরা আবার সামনের দিকে এগিয়ে চললাম ‘চলো চলো অ্যাসেম্বলি’ বলে। কিন্তু কাঁদানে গ্যাসের প্রচণ্ড ঝাঁজে আর এগোতে পারছিলাম না। তখন আমরা মেডিকেল ইমার্জেন্সিতে গিয়ে ফার্স্টএইড নিয়ে আবার রাস্তায় চলে এলাম। রাস্তায় তখন শুরু হয়ে গেছে প্রচণ্ড যুদ্ধ। মেডিকেলের মাঠ থেকে আক্রমণরত পুলিশ সদস্যদের তাক করে ছাত্ররা ইট ছুড়তে লাগল। পুলিশ লাঠি চালাতে লাগল ও অ্যারেস্ট করতে লাগল, কাঁদানে গ্যাসও ছুড়তে লাগল। তারপর প্রায় বেলা তিনটার দিকে পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে দিল। আমরা আর এগিয়ে যেতে পারিনি। ১৯৫২ মিছিলে নারীরা

ঠিক হলো, ছাত্ররা ১০ জন করে দল বেঁধে পুলিশের বাধা পার হয়ে বের হবে। মেয়েরা চারজন। সবার প্রথমে আমি তিনজন মেয়েকে নিয়ে এবং আরেকজন তিনজন মেয়েকে নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে পুলিশের বন্দুকের নল ঠেলে বের হলাম। ১৯৫২ মিছিলে নারীরা 

সামনে দেখছি আহত-নিহতদের স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসছে। তাদের রক্তে মাটি ভিজে যাচ্ছে, সবুজ ঘাস লাল হয়ে যাচ্ছে। স্ট্রেচারের সঙ্গে সঙ্গে ইমার্জেন্সিতে ঢুকছি, আহতদের দেখছি। রক্ত, রক্ত, চারদিকে রক্ত। আহতদের আমরা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। একজন ছাড়া আর কাউকে চিনতে পারিনি। তখন আমাদের ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ ছিল। তাই বেশি মুখ আমাদের চেনা ছিল না। তখন বেলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এখন যেখানে শহীদ মিনার, সেখানে বেশ কাঁদলাম। দেখি, অনেকখানি জায়গাজুড়ে রক্ত। বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। অত রক্ত একসঙ্গে কখনো দেখিনি। বাংলাদেশের পতাকার লাল সূর্যটা সেই রক্তসাগরকে মনে করিয়ে দেয়। মনে হয়, সেই রক্তসাগরেই সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ উপ্ত হয়েছিল। ওখানে আমরা দেখলাম, শহীদদের রক্তে ভেজা জামাকাপড় গাছের ডালে ঝোলানো। দেখলাম মাথার খুলি উড়ে যাওয়া রফিকের মগজ বকুল ফুলের মতো থোকায় থোকায় ছড়িয়ে আছে অনেকখানি জায়গাজুড়ে। এমন আর কখনো দেখিনি। সেই বকুল ফুল, সেই মগজ, সেই রক্তের সাগর আমাদের শপথ। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের ভবিষ্যৎ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *